অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : এক রিপোর্টেই ভিত নড়েছে ভারত তথা এশিয়ার শীর্ষ ধনী গৌতম আদানী গোষ্ঠীর। বিশ্বসেরা ধনীদের তালিকায় আদানী নেমে এসেছেন তৃতীয় স্থান থেকে একেবারে দশের নীচে। তার সম্পদের পরিমাণ নেমে এসেছে অর্ধেকে। আদানী গোষ্ঠীর এই পতনে যিনি কলকাঠি নেড়েছেন তার নাম নাথান অ্যান্ডারসন।
দিন ১৫ আগে পর্যন্ত এই নামটির সঙ্গে বিশেষ পরিচয় ছিল না ভারতীয়দের। কিন্তু তিনিই এখন চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ এই নাথানের কারণেই আদানীদের বহুদিনের খ্যাতির গায়ে কালিমা। নাথানের সবচেয়ে সব পরিচয়, তিনি আমেরিকার শেয়ার সংক্রান্ত সংস্থা ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’-এর মালিক।
বলা বাহুল্য, গত ২৪ জানুয়ারি এই সংস্থার রিপোর্টেই সারা বিশ্বের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে গৌতম আদানীদের শেয়ার কেলেঙ্কারির কথা। সেখানে বলা হয়, গত এক দশক ধরে শেয়ারের দরে কারচুপি করছেন আদানিরা। তারই জেরে সেই গোষ্ঠীর এত রমরমা। আদানিদের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের অভিযোগও আনে এই সংস্থা।
তার পর থেকে আদানি গোষ্ঠীর একের পর এক সংস্থার শেয়ারের দরে ধস নেমেছে। চাপের মুখে পড়ে নতুন শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া- এফপিও বাতিল করে দেয় আদানি গোষ্ঠী। ২০ হাজার কোটি টাকার ওই এফপিও বাতিলের পর তাদের শেয়ারের দর আরও নেমে যায়।
প্রশ্ন উঠেছে ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ কী? এই সংস্থার নেপথ্যেই বা কে আছেন? উত্তর নাথান অ্যান্ডারসন। শুধু আদানিদের নয়, ম্যানহাটনের একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্টে বাস করা নাথান এর আগেও বেশ কয়েকটি সংস্থাকে বিপদের মুখে ফেলেছেন। তার রিপোর্ট সর্বস্বান্ত করেছে একাধিক সংস্থাকে।
বলা হয়, করপোরেট সংস্থাগুলোর জালিয়াতি দূর থেকে শুঁকে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে নাথানের। তার ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ আসলে কী করে? নাথানের পরিচয়ই বা কী? আদানিকাণ্ডের পর থেকে তা নিয়ে উঠেছে একাধিক প্রশ্ন।
নাথান ‘ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাট’ থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা (ইন্টারন্যাশনাল বিজিনেস) নিয়ে স্নাতক করেছেন। এরপর তিনি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ‘ফ্যাক্টসেট রিসার্চ সিস্টেমস ইনকর্পোরেটেড’-এর আর্থিক দপ্তরে (ফিনান্স) কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি নিজের সংস্থার সঙ্গে অন্য বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলোর মেলবন্ধন ঘটানোর কাজ করতেন।
২০২০ সালে সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’কে নাথান বলেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি যে সংস্থায় কাজ করি, সেটা আহামরি কিছু কাজ করছে না।’ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইজরায়েলে বেশ কিছু দিন অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাজ করেছেন নাথান।
সামাজিক মাধ্যম ‘লিঙ্কডইন’-এ নাথান লিখে রেখেছেন, তিনি এমন একজন মানুষ যিনি অতিরিক্ত চাপের মধ্যেও সঠিক চিন্তাভাবনা এবং সঠিক কাজ করতে সক্ষম। এক সাক্ষাৎকারে নাথান জানিয়েছেন, তিনি হ্যারি মার্কোপোলোসকে দেখে অনুপ্রাণিত। হ্যারি আমেরিকার কুখ্যাত জালিয়াত বার্নি ম্যাডফের পর্দা ফাঁস করেছিলেন।
২০১৭ সালে ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠা করেন নাথান। এটি একটি ফরেনসিক আর্থিক গবেষণা সংস্থা। যা বিভিন্ন সংস্থার ‘ইক্যুইটি’, ‘ক্রেডিট’ এবং ‘ডেরিভেটিভস’ বিশ্লেষণ করে। সংস্থাটির ওয়েবসাইট বলছে, অর্থনীতিতে ‘মানবসৃষ্ট বিপর্যয়’ আটকাতে তারা বিভিন্ন সংস্থার আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং প্রকাশ্যে না আসা লেনদেনগুলোর উপর নজরদারি চালায়। নিজেদের সংস্থার খরচও নিজেরাই চালায় হিন্ডেনবার্গ। সংস্থার দাবি, নজরদারি চালাতে তারা কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেয় না।
১৯৩৭ সালের ৬ মে নিউ জার্সিতে উড়ে যাওয়ার পথে মাঝ আকাশেই আগুন লেগে যায় জার্মানির বিমান ‘হিন্ডেনবার্গ এয়ারশিপ’-এ। মাটিতে আছড়ে পড়ে মৃত্যু হয় ৩৬ জন বিমানযাত্রী এবং বিমানকর্মীরা। সেই বিমানের নামেই সংস্থার নামকরণ করেন নাথান।
কোনো সংস্থার সম্ভাব্য আর্থিক কেলেঙ্কারি খুঁজে বের করার পর তা নিয়ে ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ রিপোর্ট’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা। আদানির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই বিশ্বজুড়ে পড়ে যায়।
আদানিদের আগেও ছোট বড় অনেক সংস্থা নাথান এবং তার সংস্থার ‘নেকনজরে’ পড়েছে। এদের মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত নিকোলা গোষ্ঠীর কেলেঙ্কারি কাণ্ড। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বৈদ্যুতিক ট্রাক প্রস্তুতকারক নিকোলা করপোরেশনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আনেন নাথান।
হিন্ডেনবার্গের রিসার্চ রিপোর্টে দাবি করা হয়, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের মিথ্যা কথা বলেছে নিকোলা।
‘নিকোলা’ সেই সময় ইলন মাস্কের স্বয়ংক্রিয় এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত বৈদ্যুতিক গাড়ির সংস্থা ‘টেসলা’র সঙ্গে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করছিল। বাজারে এমন গুজবও রটেছিল যে, প্রযুক্তিতে ‘টেসলা’কে সহজেই টেক্কা দেবে ‘নিকোলা’। ‘নিকোলা’র পোস্ট করা গাড়ির ভিডিয়ো দেখেই মানুষের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু হিন্ডেনবার্গ খুঁজে বের করে, ওই ভিডিয়োগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যা ভুয়া।
হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর ‘নিকোলা’র প্রতিষ্ঠাতা ট্রেভর মিল্টনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়েছিল। গত বছর বিনিয়োগকারীদের মিথ্যা বলার এবং জালিয়াতির অভিযোগে ট্রেভরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শাস্তি হিসাবে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা ফেরত দিতে হয় তাকে।
নিকোলার বাজারমূল্যও ৩৪০০ কোটি ডলার থেকে কমে ১৩৪ কোটি ডলারে নেমে আসে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে হিন্ডেনবার্গ এখনো পর্যন্ত অন্তত ১৬টি সংস্থার আর্থিক কারচুপির রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। যার নবতম সংযোজন আদানী গোষ্ঠী।
Leave a Reply